Wednesday, November 20, 2024

৩৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ পেলেন ‘ট্রাক লাগবে’ প্রতিষ্ঠানটি

ব্যবসায়িক কাজে, বাসা বদল বা অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই মালামাল স্থানান্তর বা পরিবহনের জন্য প্রায় সময়ই আমাদের প্রয়োজন হয় ট্রাক বা পিকআপ ভ্যানের। কিন্তু প্রয়োজনের সময় অন্য যেকোনো জিনিসের মতোই, হাতের নাগালে এগুলো পাওয়াটাও ভীষণ কষ্টকর হয়ে যায়। এ ছাড়া ট্রাকস্ট্যান্ডে যাওয়া-আসার ঝামেলা, পরিচিত ট্রাক ড্রাইভারদের ফ্রি না পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণেও ট্রাক ভাড়া করার এই বিষয়টি পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। আজকের লেখায় আমরা কথা বলব এ ধরনের যাবতীয় সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারে এমন একটি সার্ভিস সম্পর্কে। ট্রাক ভাড়া করা বা ভাড়া দেওয়ার একদমই নতুন ও যুগোপযোগী এই উদ্যোগের নাম ‘ট্রাক লাগবে’।

কিছুদিন আগে এক রেটে ট্রাক ভাড়া করার সুবিধা চালু করেছে দেশের জনপ্রিয় এই স্টার্টআপটি। অর্থাৎ, ঘরে বসেই ‘ট্রাক লাগবে’ অ্যাপটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে ডাউনলোড করে সুবিধামতো ট্রাক খোঁজা যাবে। একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট রেটে মালামাল স্থানান্তর করতে পারবে অ্যাপ ব্যবহারকারীরা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে (https://trucklagbe.com) ভিজিট করেও ট্রাক ভাড়া করা যাবে।

উদ্যোক্তাদের গল্পঃ

দুই পেশাজীবী বন্ধু এনায়েত রশিদ এবং মীর হোসাইন ইকরামের প্রতিষ্ঠান ‘ট্রাক লাগবে’। প্রতিষ্ঠানটির সিইও এনায়েত রশিদ। আর চিফ অপারেটিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন মীর হোসাইন ইকরাম। সম্পূর্ণ নতুন এবং ভিন্ন কিছু করার আগ্রহ থাকলেও সহজে কোনো আইডিয়া নির্ধারণ করতে পারছিলেন না তারা। এদিকে ব্যবসায়িক পণ্য পরিবহনের জন্য মাঝে মধ্যেই ট্রাক প্রয়োজন হতো এনায়েত রশিদের। সেই খাতিরে ঘটনাক্রমে কিছু জিনিস তার নজরে এলো। বিশেষ করে ভাড়ার বিষয়টি। দুই বন্ধু মিলে এ বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনায় বসেন। সেখানেই উঠে আসে ‘ট্রাক লাগবে’র পরিকল্পনা। এবার শুধু পরিকল্পনাতেই কাজ থেমে থাকেনি, বাস্তবেও পরিণত হয়েছে।

ব্যবসার যাত্রাঃ

৩৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ পেল

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রাথমিকভাবে শুরু হয় ‘ট্রাক লাগবে’র পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজ। ২০১৭ সালের জুন মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) আয়োজিত ‘স্টার্টআপ চ্যালেঞ্জ ২০১৭’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী নির্বাচিত মোট ২০টি উদ্ভাবনী প্রকল্পের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। সে বছরই জুলাই মাসে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীদের জন্য এটির পরীক্ষামূলক (বেটা) সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

এরপর ২০১৮ সালের আগস্টে অ্যাপটির নতুন সংস্করণ আসে গুগল প্লে স্টোরে। একই বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকার আইসিটি টাওয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপটির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই যাত্রার এক বছর পেরোতে না পেরোতেই পণ্য পরিবহনের নির্ভরযোগ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি পেতে শুরু করে ‘ট্রাক লাগবে’। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম আয়োজিত প্রতিযোগিতায় দেশের ১৬৮টি কোম্পানির মধ্য থেকে ‘ট্রাক লাগবে’ জিতে নেয় ‘বেস্ট টেকনোলোজি ইনোভেশন’ পুরস্কার।

বিনিয়োগ পেলেন ৩৪ কোটি টাকাঃ

৩৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ পেলনতুন উদ্যমে শুরু করা ট্রাক লাগবে অবশ্য ব্যর্থ হয়নি বরং দেখা দিল একের পর এক সফলতা। ৪০ লাখ ডলারের ‘এ সিরিজ’ বা ইক্যুইটিভিত্তিক বিনিয়োগ পেয়েছে অ্যাপভিত্তিক ট্রাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ট্রাক লাগবে’। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমান ৩৪ কোটি ১০ লাখ টাকা (১ ডলার= ৮৫ দশমিক ২৫ টাকা হিসাবে)। গতকাল সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়  প্রতিষ্ঠানটি।

নতুন বিনিয়োগ দিয়ে ট্রাক লাগবে সারা দেশে অন্তত ২২টি জেলায় সেবাকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা করছে। ট্রাকচালকদের ট্রাক লাগবে প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে সহায়তা করা হবে এসব কেন্দ্র থেকে। চালকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। “ট্রাক লাগবে” এর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এনায়েত রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, আমরা দেশের ৬৪টি জেলায় ব্যবসা পরিচালনা করলেও শুধু বিভাগীয় শহর পর্যায়ে ট্রাকচালকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। নতুন প্রশিক্ষণের পর আগামী এক বছরের মধ্যে আমাদের প্ল্যাটফর্মে অন্তত দ্বিগুণ ট্রাক যুক্ত হবে বলে আশা করছি।

এগুলো অবশ্যই পড়বেন—

২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের স্টার্টআপ চ্যালেঞ্জে সেরা আইডিয়া বিভাগে জয়ী হয় ট্রাক লাগবে। সেখান থেকে পাওয়া ১০ লাখ টাকা নিয়ে ২০১৮ সালে ৩৬টি ট্রাক ও ৪ জন কর্মী নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত ট্রাকের সংখ্যা ৮০ হাজার, যারা প্রায় ৪৩ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে পণ্য পরিবহনে সহায়তা করছে।

ট্রাক লাগবের নতুন এই বিনিয়োগে নেতৃত্ব দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। ২১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে তারা। এ ছাড়া অন্য বিনিয়োগকারীরা হচ্ছে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড-১, নিউইয়র্কভিত্তিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মিলিভিল অপরচুনিটি মাস্টার ফান্ড, পাকিস্তানি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান শুরুখ পার্টনার্স, জাপানি প্রতিষ্ঠান কোলপল নেক্সট ও নিউইয়র্কভিত্তিক ট্রু ফান্ড।

সম্প্রতি আইএফসি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের ব্লেকবাক, চীনের ট্রাক অ্যালায়েন্স, মধ্যপ্রাচ্যের ট্রাকার ও আফ্রিকায় কোবো ৩৬০ নামক অ্যাপভিত্তিক ট্রাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে আইএফসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নুজহাত আনোয়ার বলেন, ‘আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে তাঁরা কাজও করে যাচ্ছেন। পণ্য পরিবহনে তাই দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। আইএফসি ট্রাক লাগবেকে বিনিয়োগের পাশাপাশি পরামর্শও দেবে, যেন তারা আরও বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারে।

বর্তমান অবস্থাঃ

৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ পেলমার্কেটিং ম্যানেজার আল আমিনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশজুড়ে এই সার্ভিসটি যাত্রা শুরু করে মাত্র ৫০টি ট্রাক নিয়ে। এখন নিবন্ধিত ট্রাকের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। বর্তমানে এই অ্যাপের সাহায্যে ছোট পিকআপভ্যান থেকে শুরু করে মাঝারি বা বড় আকারের খোলা ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যান ভাড়া করা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এখানে পাওয়া যাচ্ছে কনটেইনারবাহী প্রাইম মুভার। আর যদি শহরের ভেতরেই খুব দ্রুত পণ্য পরিবহনের প্রয়োজন দেখা দেয়, ‘ট্রাক লাগবে’র ‘এক্সপ্রেস’ সার্ভিসের মাধ্যমে অ্যাপ দিয়েই মুহূর্তে যে কেউ ডেকে নিতে পারবেন তার সবচেয়ে কাছে থাকা মিনি ট্রাক কিংবা পিকআপ। 

সেবাগ্রহীতাদের সর্বোচ্চ গুণগতমান নিশ্চিত করতে মূলত দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করছে অ্যাপটি। একটি হলো নির্ভরযোগ্যতা এবং অন্যটি স্বচ্ছতা। ২৪ ঘণ্টা পরিবহন সুবিধা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিবহনসেবা এবং অ্যাপের অভ্যন্তরীণ বিশেষ লোড ম্যাচিং প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো শিপমেন্টের জন্য সঠিক ট্রাক খুঁজে দিয়ে নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করছে ‘ট্রাক লাগবে’। অন্যদিকে স্বচ্ছতার লক্ষ্যে ‘ট্রাক লাগবে’-তে প্রাপ্ত সব ট্রাক যাচাই করা ও রেজিস্টার্ড। এ ছাড়া সব পণ্য পাঠানোরই ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করেছে তারা। সেই সঙ্গে সেবাগ্রহীতারা যেন সম্ভাব্য সবচেয়ে কমমূল্যে সেবা লাভ করতে পারে, সে বিষয়ে সব সময় সজাগ নজর থাকে ‘ট্রাক লাগবে’র উদ্যোক্তাদের।

আমাদের শেষ কথাঃ

এই সার্ভিসটির মাধ্যমে শুধু সাধারণ মানুষই যে উপকৃত হচ্ছেন তা নয়, পাশাপাশি ট্রাক ব্যবসায়ীরাও খুব সহজেই খুঁজে পাচ্ছেন তাদের সেবাগ্রহীতা। তা ছাড়া পণ্য বা মালামাল পরিবহনের জন্য অনেক সময় ট্রাক নিয়ে দূর-দূরান্তে, এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেতে হয়। কিন্তু সেখানে নতুন কোনো সেবাগ্রহীতা না পাওয়ায়, কিংবা স্থানীয়দের সঙ্গে তেমন চেনাজানা না থাকায়, ফিরতি পথে খালি ট্রাক নিয়েই আসতে হয়। ফলে বৃথা শ্রম ও টাকার অপচয় ঘটে।

কিন্তু এখন যেহেতু এই অ্যাপের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনেই সেবাগ্রহীতা পাওয়া যাচ্ছে, তাই ট্রাকচালক ও কর্মীদের শ্রমটাও বৃথা যাচ্ছে না। তারা যেমন বাড়তি কিছু আয়ের সুযোগ পাচ্ছে, তেমনই ক্ষতির বদলে লাভ হচ্ছে ট্রাকমালিকদেরও। সব মিলিয়ে বলাই যায়, ট্রাকমালিক, চালক, কর্মী থেকে শুরু করে সেবাগ্রহীতা, সবার জীবনকেই আরও সহজ করে দিচ্ছে ‘ট্রাক লাগবে’।


সুত্রঃ প্রথম আলো 

Businesses BD
Businesses BDhttps://www.businesslinear.com/
Lorem ipsum is a placeholder text commonly used to demonstrate the visual form of a document or a typeface without relying on meaningful content

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles